বরিশাল বিভাগের প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। প্রাচীনকালে এ অঞ্চল বাঙ্গালা নামেও পরিচিত ছিল। বাঙ্গালা নামটি পরিবর্তিত হয়ে বাকলা হয়েছে। এগারো ও তেরো শতকের তাম্রলিপিতে বাঙ্গালা ও চন্দ্রদ্বীপ নামের উল্লেখ আছে।
চতুর্দশ শতকে রাজা দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল। মোগল আমলে বাকলা সুবে বাংলার একটি সমৃদ্ধিশালী সরকার ছিল। ১৭৯৬ খ্রিঃ পর্যন্ত এ জেলা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ সরকার ১৭৯৭ খ্রিঃ ঢাকা বিভাগের বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা সৃষ্টি করে। আগাবাকের নবাব আলীবর্দী খানের সময় চট্টগ্রামের ফৌজদার এবং বাকলার একজন প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তার নামানুসারে জেলার নাম বাকেরগঞ্জ হয়েছে। ১৮০১ খ্রিঃ জেলার সদর দফতর বাকেরগঞ্জ হতে বরিশালে স্থানান্তরিত হয়। বরিশাল নামটি আধুনিককালের। জেলার নাম বাকেরগঞ্জ হলেও এ অঞ্চল বরিশাল নামেই আজও সুপরিচিত। বাকেরগঞ্জ জেলা ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে খুলনা বিভাগ সৃষ্টি হলে বাকেরগঞ্জ খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের পহেলা জানুয়ারি বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ সৃষ্টি হয়।
উত্তরে হিমালয়, পশ্চিমে বিহার ও উড়িষ্যা, পূর্বে আসাম ও ব্রহ্মদেশ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী বিস্তৃত বাংলা ভাষাভাষী ভূভাগ বাংলাদেশ। বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। বরিশাল বিভাগের বা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ভূ-প্রকৃতি আলোচনা করতে হলে বাকলার ভূ-গঠন সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক।
প্রাগৈতিহাসিককালের বহু প্রাচীন জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব-মিলনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ আর বাঙালী জাতি। শত শত নদীবেষ্টিত ভূ-ভাগে প্রাচীন কৌমজন অধ্যুষিত বঙ্গ জনপদ অবস্থিত। সেই জনপদের মানুষের মান গঠনে এখানকার প্রকৃতি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বঙ্গ জনপদের প্রকৃতি মনোহর। কিন্তু প্রলয়ঙ্করী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীকূলের মানুষকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। নদী ও সমুদ্রে আবাদী ভূমি ও ঘর-বাড়ি বিলীন হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় হাজার হাজার মানুষ ও গবাদি পশু। প্রাচীনকাল থেকে এমনিভাবে সংগ্রাম করে তাদের বাঁচতে হয়েছে। সংগ্রাম ও প্রতিবাদ তাদের সংস্কার।
বঙ্গজনের মানসিকতায় সংগ্রামশীলতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও জীবনমুখিতা সেই প্রাচীনকাল থেকে। সভ্যতা, সংস্কৃতি, জনপদ, রাষ্ট্র- সবকিছু গড়ে উঠেছে নদ-নদীর তীরে। একবার গড়েছে আবার ভেঙ্গেছে। এই ভাঙ্গা-গড়ার শেষ নেই। আমরা ভৌগোলিক ভাষা ও সংস্কৃতির যে জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ বলে জানি তা মধ্যযুগের। প্রাচীনকালে এ দেশ রাড়, পুঞ্জ, গৌড় ও বঙ্গ জনপদে বিভক্ত ছিল। এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি জনগোষ্ঠী বাস করত। বসতি ছিল বিরল। চার-পাঁচ হাজার বছর পূর্বে তারা শিকারী বা যাযাবর জীবন পরিহার করে কৃষিকাজ শুরু করে। তারা এক একটি অঞ্চলে জনপদ গড়ে তোলে। অবারিত উর্বর ভূমি। নদ-নদী, মাছে পরিপূর্ণ। জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হতো না। তাই তারা কর্মবিমুখ ও ভোগলিলু হয়েছে। জৈন, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব মতবাদ বাঙালীকে আরও কর্মকুণ্ঠ করেছে। ফলে তারা অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি বা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে। বাঙালীদের চরিত্র একদিকে মিথ্যা ভাষণ, প্রবঞ্চনা; অন্যদিকে আত্মসম্মানবোধের অভাব এবং অদৃষ্টবাদী। শত শত বছর বিদেশী শাসন-শোষণের ফলে স্বাধীনভাবে আত্মবিকাশের সুযোগ মেলেনি। বঞ্চিত দারিদ্র্যের নিয়ে জীবনে আধ্যাত্মিক শক্তি লাতের প্রয়াস, উদ্যমহীনতা ও নির্ভরশীলতা তাদের পরিচয়।
বাংলার ইতিহাস রচনা করেছে বাংলার ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী। নদ-নদী যুগে যুগে বাংলাকে গড়েছে। বাংলাদেশ গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের পলল দ্বারা সৃষ্ট। অতি পুরাকালে ভূমধ্যসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত টিচিস নামে এক সাগর ছিল। পৃথিবীর আটটি প্রাচীন শিলার মধ্যে দাক্ষিণাত্যের বৃন্দাবন ও তিব্বত অন্যতম। এই দুই পাহাড়ের মধ্যে সাগর প্রবাহিত হতো। বায়ুমণ্ডলের চাপে হিমালয় পর্বত সাগর থেকে সৃষ্টি হয় এবং সেজন্য হিমালয়ে অনেক জীবাশ্ম দেখা। যায়। প্লাইস্টোসিন যুগের প্রারছে জলবায়ু খুব ঠাণ্ডা ছিল। ফলে ভূ-ভাগের অনেকাংশ ছিল বরফাচ্ছন্ন। তখন বঙ্গোপসাগরের পানিতল অনেক নিচে নেমে যায়। সাগরতলে অনেকাংশ ছিল শুভ। কালক্রমে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে। থাকে। জলবায়ু শীতল ও শুৎ হয়ে ক্রমে উষ্ণ ও আর্দ্রতর হয়। আর অধিক বৃষ্টিপাত ও বরফ গলার ফলে বঙ্গোপসাগরের পানিতল ক্রমে উপরে উঠতে থাকে এবং হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত ছিল। আজও প্লাইস্টোসিন যুগের। লাল পানি অঞ্চল বরেন্দ্র, মধুপুর ও কুমিল্লার লালমাইতে দেখা যায়। প্রাইস্টোসিন। যুগ যদি দশ লক্ষ বছর ব্যাপৃত থাকে, তাহলে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ বছর আগে হয়ত এ ঘটনা ঘটে। তারপর নদী দ্বারা বাহিত পলিমাটি, বালি প্রভৃতি জমে জমে বাংলাদেশের ভূ-ভাগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের জন্ম মোটামুটি দুই লক্ষ বছর ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু দক্ষিণ ভাগের ভূ-গঠন ৫০ হাজার বছরের বেশি হবে না। এখানে কখন জনবসতি শুরু হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবুও ভূ-তাত্ত্বিক যুগের সাথে ঐতিহাসিক যুগের প্রারম্ভকাল পর্যন্ত একটা যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়োজন আছে। ইয়াল কেমিজ অভিযানের ফলাফলে দেখা যায় উপমহাদেশে অনেক স্থানেই বরফ যুগের সময়ে লোকবসতি ছিল- বিশেষ করে হিমালয়ের পাদদেশে ও দক্ষিণ ভারতে। কিন্তু বাংলাদেশে কোথাও এই জনবসতির চিহ্নের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি গাঙ্গেয় অববাহিকায় সাত হাজার বছরের আগেও কোন জনবসতি ছিল না। কখন এ অঞ্চলের জনবসতি শুরু হয় তা বলা কঠিন। তবে প্রায় পনেরো হাজার বছর পূর্বেও ব-দ্বীপ অঞ্চল সাগরে নিমজ্জিত ছিল। ১৮৬৩ সালে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ জেমস্ ফারগাসন এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে গঙ্গা নদীর অববাহিকা স্যাঁতসেতে, জঙ্গলাকীর্ণ ও মনুষ্য বাসের অনুপযোগী ছিল।
বাংলাদেশে প্রাচীন ভূ-ভাগে নব্য প্রস্তর এবং তাম্র প্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্ধমান জেলার অজয় নদীর তীরে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে প্রায় তিন হাজার পাঁচ শ' বছর আগের এক উন্নতমানের সভ্যতার নিদর্শন উদ্ঘাটিত হয়েছে। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছরের পূর্বের নির্মিত লোহার কুড়াল এবং নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়াতে একখানা পাথরের কুড়াল ও মূর্তি আকৃতির একখণ্ড পাথর আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায় ব-দ্বীপ অত্রাঞ্চলে কোথাও কোথাও চার-পাঁচ হাজার বছর পূর্বে জনবসতি শুরু হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে আর্যরা ভারতে আগমন করে এবং পরাজিত দ্রাবিড়দের অনেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নরতত্ত্ব আলোচনা করলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ও চন্দ্রদ্বীপের ভৌগোলিক বিবরণ পৌরাণিক কাহিনীতে আচ্ছন্ন। পৌরাণিক কাহিনীগুলো থেকে আমরা ভূ-গঠনের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি। মহাভারত ও রামায়ণে বাংলাদেশের উল্লেখ আছে। মহাভারত প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে রচিত। মহাভারতে ঐতয়ের ব্রাহ্মণে বাংলাদেশকে পাণ্ডব বিবর্জিত ও বাঙালীদের মেচ্ছ ও দস্যু বলা হয়েছে। মহাভারতে দেখা যায় কৌরব পাগুবের যুদ্ধের পর ভগবান বলরাম গঙ্গার মোহনায় স্নান করেছিল এবং রাজসূয়া যজ্ঞের জন্য ভীম সাগর তীরের মেজদিগকে পরাজিত করে প্রচুর সম্পদ আহরণ করেছিল। রামায়ণে গঙ্গা দেবীর পাতাল প্রবেশের কাহিনী বর্ণিত আছে। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী বাংলা ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন ভূতত্ত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করে। বাংলার ঐতিহাসিক যুগের ঘটনাগুলো ভূতত্ত্বের নতুন দিক নির্দেশ করে। আলেকজান্ডারের খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ খ্রিস্টাব্দের ভারত আক্রমণ, গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত গঙ্গারিডি রাষ্ট্র, মেগাস্থিনিসের বিবরণে গঙ্গার মোহনায় মোদকলিঙ্গ দ্বীপের অবস্থান, মৌর্য ও ৩৫ বংশ কর্তৃক বঙ্গদেশ শাসন, প্রাচীন গৌড় ও পুঃ নগরের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ঘটনা ঐতিহাসিক যুগের সাথে একটা যোগসূত্র নির্ণয় করেছে।
মোহনায় সাগরদ্বীপে দেবতাদের স্নান ও ভীমের সাগরদ্বীপ আক্রমণ প্রভৃতি কাহিনী থেকে মনে হয় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অবস্থান চার হাজার বছর পূর্বে ছিল। গঙ্গার মোহনায় মেগাস্থিনিসের বর্ণিত মোদকলিঙ্গ দ্বীপ বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বলে মনে হয়। গৌরনদী থানার মেদাকুল গ্রামটি মোদকলিঙ্গ দ্বীপের নাম হতে পারে। তারপর প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের সাথে প্রাচীন বাংলার যোগসূত্র জানতে পারলে আমরা এ অঞ্চলের ভূতত্ত্বের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে অভিহিত হতে পারি। মহাভারত ও রামায়ণে গঙ্গার দ্বিতীয় শতকে মি. টলেমি ও প্লিনির বিবরণে চন্দ্রদ্বীপের অবস্থান পাওয়া যায়। রাজা চন্দ্রবর্মণ চতুর্থ শতকে কোটালীপাড়ায় দুর্গ নির্মাণ করেন। গৌরনদী থানার সীমান্ত থেকে কোটালীপাড়ার দূরত্ব পাঁচ-ছয় মাইল। ১৮৭৩ খ্রিঃ পর্যন্ত কোটালীপাড়া থানা বাকেরগঞ্জ জেলাধীন ছিল। তাহলে দেখা যায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান বরিশালে) লোকবসতি ছিল। ষষ্ঠ শতকে কোটালীপাড়ায় প্রাপ্ত পাঁচখানা তাম্রশাসন থেকে প্রমাণিত হয় মৌর্য ও গুপ্ত আমলে চন্দ্রদ্বীপ একটি উন্নত জনপথ ছিল। মিঃ নীহাররঞ্জন রায়, মিঃ বেভারিজ প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেন এ জেলার ভূ-গঠন নতুন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকে চন্দ্রদ্বীপের ভূ-গঠন আলোচনা করলে দেখা যায় এ জেলার উত্তর অঞ্চলের ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগে হয়েছে। গৌরনদী, উজিরপুর, হিজলা ও মুলাদী থানার অধিকাংশ ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগের।
তথ্যসূত্র: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, লেখক- সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস