উনিশ শতকের মধ্যভাগ হতে বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব প্রসার ঘটে। বিশ শতকের চার দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যুগ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি লিখে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এ যুগের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কামিনী রায়, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ অনেক শক্তিশালী কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়। এ সময় সংবাদপত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পে এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়।
১৯০১-৪৭ খ্রিঃ এ সময় বরিশাল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ অবদান রেখেছে। নিম্নে বরিশালের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো।
কবি কামিনী রায় মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গীতিকবি। তার লেখা কাব্য আলোছায়া ১৮৮৯, নির্মাল্য ১৮৯১, পৌরাণিকী ১৮৮৭, ধর্মপুত্র ১৯০৭, অশোক স্মৃতি ১৯১৩, মাল্য ও নির্মাল্য ১৯১৩, অশোক সঙ্গীত ১৯১৪, উষা ১৯১৪, দীপ ও ধূপ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তিনি নতুন আকাঙ্ক্ষা, আশার পথে, নীরবে, যৌবন তপস্যা, একলব্য, গুঞ্জন, জনৈকা জননী প্রভৃতি কবিতা রচনা করেন। তিনি অম্বা (১৯১৫) ও সিতিকা (১৯১৬) নাটক লিখেছেন। তার লেখা ঠাকুর মায়ের চিঠি ১৯২৪, জীবন পথে ১৯৩০, বালিকা শিক্ষার আদর্শ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। নব্য ভারত, প্রভাতী, বিচিত্রা, বঙ্গলক্ষ্মী প্রভৃতি তার অপ্রকাশিত লেখা। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগৎ তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল সাহিত্য পরিষদ তাকে সংবর্ধনা জানায়। কামিনী রায় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর দেহত্যাগ করেন।
মুন্সী মুহাম্মদ রিয়াজ উদ্দীন (১৮৬২-১৯৩৪) বরিশালের কাউনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং খুলনা জেলায় বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। তিনি তোহ-ফেতুল, মুসলেমীন, গ্রীক, তুরস্ক, যুদ্ধ, হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফার (সাঃ) জীবন চরিত, বিলাতী মুসলমান, কৃষক-বন্ধু (কবিতা), আমার সংসার জীবন, জোলেখা, উপদেশ, রত্নাবলী, মুসলিম সাহিত্যের ইতিহাস, ইসলাম তত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি সুধাকর, মুসলমান, নব সুধাকর, ইসলাম প্রচারক, সুলতান এবং নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
দেব কুমার রায় চৌধুরী (১৮৮৪-১৯২৯) লাখুটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রাখাল রায় চৌধুরী। তিনি বরিশাল সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি একাধারে কবি ও প্রবন্ধকার ছিলেন। অরুণ, মাধুরী, দেবদূত, ধারা, প্রভাতী তার কাব্যগ্রন্থ। তিনি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের জীবনী রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী, ১৮৮৫-১৯২১) বেদান্ত দর্শন, রাজনীতি, সরলতা, দুর্বলতা, রাজা-প্রজা ও কর্মতত্ত্ব প্রভৃতি তার রচিত গ্রন্থ।
চারণ কবি মুকুন্দ দাশ (১৮৮৭-১৯৩৪) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চারণ কবি। সমাজ, পল্লী, সেবা, ব্রহ্মচারিণী ও কর্মক্ষেত্র তার সাড়া জাগানো যাত্রা নাটক। তার সঙ্গীত গ্রন্থ সাধন সঙ্গীত।
হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কবিরত্ন বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রী নিবাসী। হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৮৮-১৯২৯) আর একজন চারণ কবি। তিনি মুকুন্দ দাশের জন্য যাত্রা লিখে দিতেন এবং নিজে যাত্রা করতেন। তিনি প্রথম জীবনে উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন। অশ্বিনী কুমার দত্তের সংস্পর্শে এসে তার জীবনে পরিবর্তন আসে। তার বিখ্যাত কাব্য 'কতকথা' ও 'কণা'।
জিতেন্দ্র কুশারী সুগায়ক ও বিপ্লবী ছিলেন। তিনি পথের সন্ধানে ও গান্ধীজি স্মরণে রচনা করেন। তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে যান এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেহ ত্যাগ করেন।
নিশিকান্ত নলছিটি থানার মানপাশা গ্রামে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা, পরাধীনের মুক্তি, চলার পথে, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, সরস্বতী, অশরীর জীবন প্রভৃতি বই লেখেন।
সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কাজলাকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রহমান খাঁ, দুর্গা উৎসব, মানসী, মাধব প্রভৃতি বই লেখেন।
যোগেশ চন্দ্র বড়াল ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কোরালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শেষের জয়যাত্রা মুক্তির সন্ধানে ভারত, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি বই রচনা করেন।
শান্তিসুধা ঘোষ ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। নারী ও সতীন্দ্রনাথ সেনের জীবনী তার রচিত গ্রন্থ। গৈলা নিবাসী কার্তিক চন্দ্র দাশগুপ্ত সাবিত্রী, নিশিকান্ত প্রভৃতি পুস্তক রচনা করেন। এ গ্রামের আনন্দ চরণ সেন গৃহিনীর কর্তব্য ও চন্দ্রনাথ দাশ কয়েকটি চিত্র পুস্তক লেখেন। মাহিলারার রামচন্দ্র দাশগুপ্ত রচিত জাগরণ, দীক্ষা, দৈববাণী প্রভৃতি গ্রন্থ স্বদেশী আন্দোলনকে প্রেরণা দান করে।
শরৎ কুমার রায় চৌধুরী বুদ্ধ ভারত, বুদ্ধের জীবন, হেমন্ত কুমার, হেমন্ত চন্দ্র এবং শাস্তিরঞ্জন প্রভৃতি পুস্তক রচনা করেন। কাশীপুরের প্রতাপ চন্দ্র কাশীপুর নিবাসীর সংগ্রহ, কাশীপুর কুসুম রচনা করেন। বৃন্দাবন পুততুণ্ড ১৩২০ সালে চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস রচনা করেন। বিপ্লবী মনোরঞ্জন গুপ্ত রবীন্দ্র চিত্রকলা, যারা হারিয়ে গেল, সমবায় দর্শন, বিপ্লবী স্বপ্ন প্রভৃতি রচনা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল সম্পাদনা করেন। অরুণ গুহ দেশ পরিচয়, খেলাফত প্রসঙ্গ, নব্য এশিয়া, চন্দ্র ৩৫ জীবনের বসন্ত, সৃষ্টি ও সভ্যতা প্রভৃতি বই লেখেন।
নরেশ চন্দ্র ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে টিপুর নিষ্কৃতি, বৈজয়ন্তী প্রভৃতি পুস্তক রচনা করেন। অমরেন্দ্র ঘোষ ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সুক্তাগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পদ্মাদীঘির বেদেনী, দক্ষিণের বিল, একটি সঙ্গীতের জন্ম কাহিনী, বেআইনী জনতা, কনকপুরের কবি প্রভৃতি বই লেখেন। মিহির সেন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ঈসপের গল্প, ভাই ভাই, সেরা গল্প, সবার উপরে প্রভৃতি বই রচনা করেন। তারেকশ্বর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ভোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পরিচিত, চলার পথে ও আমি কাব্য লেখেন। অনন্ত বন্ধু দত্ত ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ব্যাংকের কথা লেখেন।
ডাঃ শশী ভূষণ দাশগুপ্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রেম চাঁদ রায় স্কলারশীপ লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি এপারে-ওপারে, বাংলা সাহিত্যের নবযুগ, বাংলা সাহিত্যের একদিক, সাহিত্যের স্বরূপ, শিল্পলিপি, শ্রীরাধা, ক্রমবিকাশ, দর্শন ও সাহিত্য, রাজকন্যার ঝাঁপি, দিগন্তের আগুন (নাটক) এবং বিদ্রোহিনী রচনা করেন।
মৌলভী ফজলুর রহমান চৌধুরী ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এ কে ফজলুল হকের কন্যা রইসা বেগমের প্রথম স্বামী। তিনি সোহরাব-রুস্তম কাব্য, মহরম কাব্য, পয়গম্বর কাহিনী, ইসমাইল বংশীয় নবীগণ, সুবর্ণ কুঞ্জিকা, মেশকাত শরীফ, বাংলা কোরআন, সুন্নার পঞ্জিকা প্রভৃতি রচনা করেন। তিনি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন। নুরুল হক চৌধুরী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে উলানিয়া জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তার শিক্ষা জীবন শেষ হয়। তিনি সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিকদের উত্তরে কালাপাহাড় (১৩২৭ বঙ্গাব্দ) আকর্ষণ ও বঙ্গ জমিদার রচনা করেন। তিনি ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন।
মৌলভী এমদাদ আলী মাস্টার ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ৯ এপ্রিল ভাণ্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শার্ষিনার পীর শাহ সুফী হাজী নেছার উদ্দীনের ভক্ত ছিলেন। তিনি তারিখই ইসলাম, মোসলেমের রত্নহার, তালিমের মারেফত, হযরতের ভবিষ্যৎ বাণী প্রভৃতি ৩০ খানা কেতাব রচনা করেন। তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জেলা জজ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের রূপ, মেশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ, আদর্শ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), শরীয়ত শিক্ষা, মানব ধর্ম প্রভৃতি রচনা করেন।
পীর সাহেব শাহ সুফী হাজী নেছার উদ্দীন আহম্মেদ স্বরূপকাঠি থানার শর্ষিনা গ্রামে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তারিকুল ইসলাম ১১ খণ্ড, ফাতেমা সিদ্দিকী (রাঃ), তালিমে মারেফাত, নারী ও পর্দা প্রভৃতি অনেক কেতাব রচনা করেন। তিনি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন।
মির ফজলে আলী বামনা থানার চালিতাবুনিয়া গ্রামে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিএম কলেজ হতে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বিএল পাস করেন। তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল বারে যোগ দেন। তার উদ্যোগে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সাপ্তাহিক নকীব পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ কোরান কণিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেহ ত্যাগ করেন। এ কে ফজলুল হকের ভগ্নি আফজালুন নেসা রত্নাধার গ্রন্থ এবং ভাগ্নি মোসাম্মৎ সারাতৈফুর স্বর্গের জ্যোতি গ্রন্থ রচনা করেন। উকিল মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) জীবনী রচনা করেন।
মুন্সি ইয়াসিন হাওলাদার বাকেরগঞ্জ থানার বাগদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের দয়া প্রজার শাসন এবং ১৩৪৫ সনের ১৬ কার্তিক হক সাহেবের নতুন আইন, প্রজার মুক্তি প্রণয়ন করেন।
জীবনানন্দ দাশ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের বগুড়া রোডে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সর্বানন্দ দাশ বিএম স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তার মাতা কুসুম কুমারী দাশ কবি ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজী সাহিত্যে এমএ। তিনি বিএম কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি দেশ বিভাগের পর ভারতে চলে যান এবং ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর এক ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ ত্যাগ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ঝরা পলক ১৯২৮, ধূসর পাণ্ডুলিপি ১৯৩৬, বনলতা সেন ১৯৪২, মহাপৃথিবী ১৯৪৪, সাত তারার তিমির ১৯৪৮ প্রভৃতি কাব্য লেখেন। তার লিখিত কবিতা রূপসী বাংলা ১৯৫৭, বেলা-অবেলা কাল বেলা ১৯৬১, কবিতার কথা ১৯৫৪, বাংলা ১৯৫৪ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়। ভারত সরকার তার বাংলা কবিতার জন্য ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পুরস্কার প্রদান করেন। তিনি জীবন ও প্রকৃতিকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন। সর্বোপরি বাংলার প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা। 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাহি না আর' এবং 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি নদীর তীরে এই বাংলায়' প্রভৃতি তার জনপ্রিয় কবিতা।
কবি মোজাম্মেল হক ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভোলার বাপ্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বিএ পাস করেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তার 'জাতীয় মঙ্গল' কাব্য প্রকাশিত হয়। তিনি ডঃ শহীদুল্লার সাথে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমী কর্তৃক পুরস্কৃত হন। তিনি ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন।
সুফিয়া কামাল ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা সাবেরা বেগম সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের কন্যা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিলদুর গ্রামের সৈয়দ আব্দুল বারী সুফিয়া কামালের পিতা। তার ৭ বছর বয়সের সময় তার পিতা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তার মা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। ১২ বছর বয়সে মামাত ভাই নেহাল হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে তিনি লেখাপড়া করেন। ১৩ বছর বয়সে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সরসদত্ত ও সুকুমার দত্তের সম্পাদিত মাসিক তরুণ পত্রিকায় তার প্রথম লেখা 'সৈনিক বধূ' প্রকাশিত হয়। তার স্বামী ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তিনি ১৯৩৩ হতে ১৯৪১ খ্রিঃ পর্যন্ত কলকাতা করপোরেশনের স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তার দ্বিতীয় স্বামী চট্টগ্রামের মুহাম্মদ কামাল, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম রচিত কাব্য গ্রন্থ 'সাঁঝের মায়া' এবং ছোট গল্প, উপন্যাস, কেয়ার কাঁটা' ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তার রচিত মায়া কাজল ১৯৪১, মন ও জীবন ১৯৫৭, উদাত্ত পৃথিবী ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলাদেশ নারীমুক্তি আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
সৈয়দ আব্দুল মান্নান ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই চাঁচৈর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখক ও সাংবাদিক। তার বনের ফুল ১৯৩৬ ও তাপস কাহিনী ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ২৩ আগস্ট তিনি দেহ ত্যাগ করেন।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নলচিড়া গ্রামে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিশালী লেখক। তিনি উপনিবেশ, কালাবদর, বৈতালিক, মহানন্দ প্রভৃতি ৫০/৬০ খানা উপন্যাস রচনা করেন।
হীরালাল দাশগুপ্ত ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মাহিলারায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাঘের জঙ্গলে, মায়ামৃগ, জননায়ক অশ্বিনী কুমার, স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর পরলোকগমন করেন। সুরেশচন্দ্র গুপ্ত (রাজাপুর) অশ্বিনী কুমারের ভক্ত ও হরিজন নেতা ছিলেন। তিনি অশ্বিনী কুমার দত্তের জীবনী রচনা করেছেন।
কবি আহসান হাবীব ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শংকর পাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিরোজপুর সরকারী স্কুল হতে মেট্রিক পাস করে বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক কারণে কলেজ ত্যাগ করে তাকে কলকাতায় বিভিন্ন পত্রিকায় চাকরি করতে হয়। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তার কাব্যগ্রন্থ রাত্রি শেষ ১৯৪৮, ছায়া হরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাব ও দু'হাতে দুই আদিম পাথর, প্রেমের কবিতা, বিদীন দর্পণে মুখ। অরণ্য নীলিমা, জাফরানী রং, পায়রা, রানী খালের সাঁকো প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করেন। চল্লিশের দশকে তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পঞ্চাশ হতে আশি দশক পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিচরণ করেছেন। তিনি ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুলাই দেহ ত্যাগ করেন।
ড. হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পোনাবালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রধান ছিলেন। তিনি জেলার প্রথম পিএইচডি। তিনি ইংরেজী ভাষায় কয়েকখানা ভারতের ইতিহাস রচনা করেন। ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন পিএইচডি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে চ্যান্সেলর ও আরকাইভের পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ইংরেজী গল্প ও ভারতের ইতিহাসের ওপর গ্রন্থ রচনা করেন। তার কন্যা মৈত্রেয়ী দেবী মংপুতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন। ডিএন রায় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কুশাঙ্গলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দর্শনের ওপর ইংরেজী ভাষায় কয়েকখানা পুস্তক রচনা করেন। ডঃ কালীকান্ত ভট্টাচার্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বভারতীতে দর্শনের প্রধান ছিলেন। তিনি দর্শন শাস্ত্রের ওপর কয়েকখানা পুস্তক রচনা করেন।
বিশ শতকের প্রথম ৪৭ বছর ছিল জ্ঞান চর্চার স্বর্ণ যুগ। এ সময় বরিশাল সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ও ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর অধিকাংশ গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, লেখক- সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস